নাজমুল হাসান অনিকঃ
মানুষের জীবনে জন্মের পর হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটি জিনিষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে হয়। আর সে জিনিষটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা গ্রহন এবং সে শিক্ষায় শিক্ষিত হবার মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজেকে বসিয়ে দিতে পারে এক অনন্য উচ্চতায়। স্কুল থেকে শুরু হয়ে যে শিক্ষার সর্বশেষ স্থান হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে,আজকে সে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই বলে যাব। সাত রঙে রাঙানো অনেকটা সপ্নের মত এক জীবনের কথাই আজকের মূল উপজীব্য বিষয়।
সেই শিশু শ্রেণী থেকে শুরু হয় আমাদের শিক্ষা গ্রহনের অগ্রযাত্রা। স্কুল পেরিয়ে কলেজ এবং কলেজ পেরিয়ে শেষে বিশ্ববিদ্যালয়। এই যে কতগুলা ধাপ পেরিয়ে আমাদের আসতে হয় সে প্রত্যেকটা ধাপেই আছে আমাদের চলার পথের সকল লুকোনো গুপ্তধন। ধাপে ধাপে আছে আমাদের বাস্তব শিক্ষা।মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাচেতনার উন্নতির সাথে সাথে প্রত্যেকটা গন্ডি আমাদের পার হতে হয় খুব সতর্কতার সাথেই।ঠিক যখন আমরা একদম উচ্চশিক্ষার একটা অবস্থানে এসে পৌছে যাই,তখন আমাদের সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জায়গাটা এমন একটা জায়গা যেখানে নেই কোন বাধাধরা নিয়ম কানুন। স্কুলের মত সবসময় বকুনি খেতে হয় না,টিচারদের মার খেতে হয় না। এখানে প্রত্যেকে স্বাধীন। প্রত্যেকেই তৈরী করে নেয় নিজের মত আলাদা এক জগৎ। যে জগতে আছে শুধু মুক্ত বিহঙ্গের মত গোধুলীর স্নিগ্ধ আলোতে,প্রানখোলা বায়ুতে ইচ্ছামত বিচরণ করার সুযোগ। খাচার বাইরে এসে এরকম একটি জগতে যখন আমরা পড়ে যাই তখন অনেক দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। ঐযে খাচায় আটকে রাখা পাখিকে যখন অনেকদিন পরে খাচার দরজা খুলে দেয়া হয়,তখন সে বুঝতে পারেনা যে উড়বে কি উড়বে না।আমাদের অবস্থাটাও ঠিক সেরকমই হয়।অনেকেই আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে পারে এই এত বড় একটা প্রাঙ্গনে এসে।আবার অনেকেই হয়তো বর্ষাকালের নদীর স্রোতের মত ভেসে যায় অকুল পাথারে
আমি অনেক দেখেছি এরকম, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এত বড় একটা গন্ডিতে হঠাৎ করে এসে তাল মিলাতে পারে না অনেকে। অনেকটা ভোজবাজির মত উবে যায় তখন তাদের সকল আনন্দ,উল্লাস।সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের। যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসে তারা তাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাসে,সে স্বপ্ন শেকড়েই নুইয়ে পড়ে যখন দেখে এইরকম পরিবেশে তারা মানিয়ে চলতে পারেনা। শহুরে সদা চঞ্চল আর চতুর ছেলেমেয়েদের ভিড়ে এরা নিজেদের কেমন যেন বেমানান মনে করে। নিজ থেকেই একটু দূরে দূরে সরে থাকে। কারন তাদের সাথে যে ওদের মিলেনা কিছুতেই। কিন্তু একটা আশ্চর্যের এবং সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার হচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলা কেন যেন খুব মেধাবী হয়।গ্রামের সেই ছোট্ট কুঠুরিতে দরিদ্র ঘরের সন্তানগুলা কেন জানি জীবনকে সবচেয়ে বেশি পরিমানে অনুভব করতে পারে। এই ছেলেমেয়েগুলা একদিন মিশতে শুরু করে বাকি সবার সাথে। জড়তা কাটিয়ে ওঠে একসময়। ক্লাসের প্রথম সারিটা এরাই দখল করে নিয়ে নেয়।শহুরে ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়।কি মনে হয়?শহুরে ছেলেরা তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়? কখনোই নাহ। আসলে এই গন্ডিটাকে তো বুঝতে হবে তাই না।বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিটা এত বৃহৎ যে এখানে কখনো কাউকে বলে দিতে হয় না সম্মান দেয়ার কথা,ভালোবাসার কথা।এরা নিজেরাই যথেষ্ট পরিনত। সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব এদের ক্যাম্পাসের মাটিতে পা দেয়ার সাথে সাথেই তৈরী হয়ে যায়।
আহা ক্যাম্পাস। প্রানের ক্যাম্পাস। এই কথা বলাতেও একটা গর্ব আছে। এইযে সুবিশাল মাঠ,ক্যান্টিন,গাছতলা,ভবন,চত্বর,ক্যাম্পাস বাস এই প্রত্যেকটা জিনিস কি অপূর্ব মহিমায়,স্নেহের বন্ধনে সবাইকে জড়িয়ে রাখে সেটা হয়তো কেউ কখনো আঁচ করতে পারে না। বাসে করে ক্যাম্পাসে আসা,ক্লাস করা,এক্সাম দেয়া এসব রুটিনগুলো কি শুধুই শিক্ষার জন্য ফলো করা? মোটেই না।এখানে সবাই আসে হৃদয়ের টানে,আত্নার টানে।এক অদৃশ্য জাদুমন্ত্রবলে এখানে সবাই বাধা পড়ে থাকে। কেউ কাউকে না দেখতে পারলেও থাকতে পারে কিন্তু ঐযে মনের মধ্যে একটা খচখচানি থাকে।তাই ক্যাম্পাস মিস?সেটা আসলে অসম্ভব। বন্ধুবান্ধব আছে না। তাদের সাথে দেখা না হলে কি মনের সাধ মেটে। ঐযে কবি বলে গিয়েছেন-“আমার সাধ না মিটিল,আশা না ফুরাইল”।ঠিক সেরকমই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। ক্লাস শেষে উত্তপ্ত ক্যান্টিনে চায়ের কাপে উঠবে ঝড়,চলবে মাতামাতি,হৈ হল্লা,চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ। নাকে এসে লাগবে গরম গরম শিঙাড়া আর পিয়াজের একটা ঝাঁঝালো ভাপ।আহ সারাদিনের সার্থকতা তো এই এক ঘ্রানেই আমার মনে হয়। কত কথা,কত আলাপ চলবে ঘন্টার পর ঘন্টা। কারো কোন হুশ থাকে না। ওদিকে একদল যাবে মাঠে। চলবে নিত্য খেলাধুলা। এসব দেখে আবার একদল আঁতেল মুখ ভেংচি দিবে।এদের আবার পড়াশুনা ছাড়া বাকি সবেই এলার্জি।হা হা হা।এরা আসলেই অন্যরকম,তবে প্রচন্ড পরিশ্রমী।
একদলকে দেখা যাবে লাইব্রেরিতে বই মুখ গুঁজে বসে আছে।পড়াশুনা তাদের রন্ধ্রে। ওহ আরো একদলের কথা তো বলাই হয়নি।লাইব্রেরীর এক কোনে দেখা যাবে এক জোড়া যুবক যুবতীকে। হ্যা ঠিকই ধরেছেন প্রেমিক যুগল। বই পড়ার চেয়ে প্রেম করাতেই তারা আসলে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী।শুধু লাইব্রেরিতেই না।এরকম যুগলদের দেখা যাবে সারা ক্যাম্পাসব্যাপী। হয়তো দেখা যাবে কোন গাছের নিচে,স্নিগ্ধ ছায়ায় বসে আছে। আর নয়তো কোন নির্জন,নীরব জায়গায় বসে আছে। হাতে হাত,কাঁধে কাঁধ রেখে তারা স্বপ্ন বোনায় মত্ত। কিন্তু তারা কি জানে যে বাস্তবতা তাদের আড়ালে থেকে মুচকি মুচকি হাসছে। এই হাতে হাত ধরা যুগলরাই একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।বিশ্ববিদ্যালয় শেষ,তাদের সেই সপ্নেরও সলিল সমাধি রচিত হয়ে যায়।শুধু তাদের সে সপ্ন দেখা দিনগুলোর সাক্ষী রয়ে যায় সেই গাছটি যে গাছের তলায় একদিন সপ্ন দেখেছিল ঘর বাধার।উত্তরের দমকা বাতাসে স্বপ্ন উড়ে গেল এক ঝলকে।
কিন্তু থেমে থাকে না কখনো এই প্রাঙ্গনের কোলাহল।উৎসবে,অনুষ্ঠানে সর্বদা মুখরিত থাকে আমাদের এই তীর্থস্থান।হয়তো দেখা গেল পরীক্ষার ফলাফলে হতাশ হয়ে পড়ে রইল কেউ।কিন্তু তার সে হতাশা অল্প সময়ের জন্য।কারন বন্ধুরা থাকলে কখনো কেউ হতাশ হতে পারে না।এরা ঠিকই সবকিছু সামলে নিয়ে আসে।কত শত রজনী কেটে যায় বিনিদ্র কোলাহলে। সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়ায় স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে নতুন করে।
মুক্ত চিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই প্রাঙ্গনে পদচিহ্ন রেখে যায় কত না নামীদামী মানুষ। যাদের পদচারনার একদিন মুখরিত ছিল এই ক্যাম্পাস,তারাই একদিন উজ্জ্বল করে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি। সেই যে ছেলেটি,যে সবসময় হাসিখুশিতে ভরিয়ে রাখত সব,কি জানি কি কারনে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। জীবনের নির্মমতায় হতাশায় নিমজ্জিত হয় সে। কিন্তু আরেকটি ছেলে যার দিন কেটেছে হতাশায়,সময় কেটেছে একাকী সে একদিন খুব বড় হয়।
বন্ধুদের আড্ডার শিরোমনি ছেলেটিকে একদিন বিদায় নিতে হয়। লাইব্রেরিতে মুখে বই গুজে বসে থাকা ছেলেটিও বুঝে যায় রাস্তা ফুরিয়ে এসেছে।চায়ের কাপের ধোঁয়া ওঠাও বন্ধ হয়ে যায়। হুট করেই সময়টা যেন এক জায়গায় এসে থেমে যায়। বিদায় জানাতে আসে। আর সে চলতে চায় না। মুহূর্তের কোলাহলকে সে রূপ দেত অতীতে। সবই অতীত হয়ে যায় সব। জীবনকে উপভোগ করার আগেই কেউ যেন আবার শেকল বেধে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জানান দেয় তোমার সময় শেষ। পাওয়া না পাওয়া,শূন্যতা পরিপূর্ণতার জীবন এক লহমায় যেন শেষ হয়ে যায়। এবার সময় হয়েছে নতুনের আগমনের। কেউ চায়না এরকম সময় আসুক।বাধভাঙ্গা আনন্দে কেউ বাধা পড়ুক সেটা চায় না।কিন্তু বিধাতা জানে সময়কে ধরে রাখা যায় না।একদিন সকলকে বিদায় জানাতে হয়। সুখের সময় কখনো চিরস্থায়ী হয় না।একটা সময় তারও ডাক পড়ে যায়। আহা এতগুলো বছর যেন চোখের সামনে দিয়ে উবে গেল। এত ক্ষুদ্র এ সময়? কবির ভাষায় তবে বলতেই হবে-
“হায় জীবন এত ছোট কেনে এ ভুবনে?”
লেখক
এস এম নাজমুল হাসান অনিক
বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
শিক্ষাবর্ষ -(২০১৭-১৮)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,গোপালগঞ্জ।