সাধারণের মতই আজকের একটা দিন ছিলো, অস্বাভাবিক কিছুটা চেনা জায়গাটা ছাড়া সবই ছিলো স্বাভাবিকই। তবে আজকের দিনটা আমার মত সুখী মানুষের কর্মহীন ও ব্যস্ততাহীন ছিলোনা।
আজকের দিনটা ছিলো একজন মার্কেটিং রিপ্রেজেনটেটিভ চাকুরিজীবির চাইতেও ব্যস্ততম। কিন্তু আমি আগে থেকেই জানতাম আজকে আমার খুবই ব্যস্ততায় কাটবে।
তো, শুরু করলাম সাধারণের মত করেই দিনটাকে। অবশ্য, নিতান্তই সাধারণ বলাও চলেনা কারণ অন্যান্য দিনে আমি ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলেও আজকের দিনটা শুরু হয়েছিল খুবই সকালে। এলার্ম বাজার কথা ছিলো ৫:৩০ কিন্তু, আমি ৫ টার মধ্যেই উঠে গেলাম। শুরু হলো আমার দীর্ঘ প্রতিক্ষার যাত্রা, বাসা থেকে বেড়োতে বেড়োতে আমার ৬:২০ এর মত বেজে গেল, আর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৭ টার মত বেজে গেলো।
মানুষের কিছুটা ভিড়ের মাঝে আমি বাসের মাঝামাঝি একটা সিট ম্যানেজ করতে সক্ষম হলাম, আর শুরু হলো আমার দেখা কিছুটা আর্তনাদ আর আকাশ সমপরিমাণ বা তার চাইতেও বেশি অনেকটা দায়িত্ববোধ ও অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। যা কখনোই কেউ মাপকাঠিতে হয়তো বিচার করতে পারবে না।
আমি বাসের টিকিট গ্রহণ শেষে, কয়েক পা এগিয়ে গেলাম টিকিটের সিট নাম্বার দেখতে। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখলাম, একটা মেয়ে বসে আছে বেঞ্চের মাঝে, সঙ্গে একজন মাঝামাঝি বয়সের মহিলা। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে, কিছু বলছে না,চোখে চশমা, মুখে মাস্ক পরা, স্যালোয়ার আর একটু উঁচু টাইপের হিল পায়ে ছিল, বয়স ২০-২১ হতে পারে। আমি টিকিট দেখে সামনের দিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটা হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি ভাবলাম হয়তো আমার কোনো কিছুর ব্যাপক অসাবধানতা অথবা কোনো একটা কিছুতে আমার ক্রুটি থাকতে পারে, তাই আমিও কিছুটা খেয়াল করলাম নিজেকে, আমার কোনো কিছুতে ক্রুটি আছে কিনা, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমি নিজের প্রতি অযত্ন খেয়াল করিনি। অন্যদিনের মত নিজেকে এলোমেলো ফেলে দেইনি, ঘুছিয়ে নিয়ে এসেছি।
কিছুক্ষণ, চোখের ভাষার বিনিময় হলো মেয়েটার সাথে, আমিও মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছি, সেও মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে, এভাবে কিছু সময় শেষে দেখি মেয়েটা তার মাস্ক খুলে ফেললো। আর তার পরেই দেখলাম একটা সৃষ্টি, দেখতে পেলাম একজন বিষন্ন সুন্দর মেয়ে আমার সামনে বেঞ্চে বসে আছে,তাকিয়ে আছে আমার দিকে।কিন্তু বুঝতে পারলাম না মেয়েটা কেন তার মাস্কটা খুলে ফেললো, এটা কি শুধুই ছিলো তাকে দেখানো আমার প্রতি তার করুনা নাকি অন্য কিছু? ভালোই তো দেখাচ্ছিল তাকে মাস্ক পরা অবস্থায়। তবে চোখে চশমা, হালকা বেনি করা চুল আর সিম্পল সাজের মাঝে মেয়েটাকে দেখতে প্রকৃতির মতোই সুন্দর লাগছিলো। কিন্তু আমি প্রকৃতির টানে শর্তগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের দিকে মনোনিবেশ করলাম, আর আমার নিয়মের বহির্ভূত করলাম, পৃথিবীতে সুন্দর মেয়ের দিকে তাকানোর চেয়ে স্বার্থপরতা বোকামি আর নেই। আর সুন্দর মেয়েরা কখনো উপন্যাসের উদাহরণ নয়।
কিছুক্ষন পরে আমি একটু সরে গিয়ে এককাপ রং চা খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে, তাকে চায়ের স্টলের সামনে নিয়ে যেতে সক্ষম হই, আর এককাপ চা,ও কিছুটা মুঠোফোনের চার্জ নষ্ট করে, সময়ের অপচয় করতে থাকি, চা শেষে হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখি, মেয়েটা কোথাও নেই।
তারপর আস্তে আস্তে সময় গরিয়ে বেজে গেল, ৭:৪০, বাস ছেড়ে দিবে টাঙ্গাইল থেকে রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশ্য। সবার মত আমিও উঠে গেলাম বাসের মধ্যে, আর ভিতরে গিয়ে আবিষ্কার করলাম নতুন আরেকটা চরিত্র। আর আজকের এই আমার দেখা বাস্তবের ছোট লেখাটা তাকে নিয়েই।
বাসের ভিতরে উঠার পর দেখলাম সেই মেয়েটাকে আমার সামনের সিটে বসে আছে জানালার পাশে, সাথে তার মা। পৃথিবীর সকল সন্তানের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল, আর তাদের পিছনের সিটে আমার পাশে একটা লোক বসা, সে আর কেউ নয় সে হলো ওই কাঙ্ক্ষিত মেয়েটার বাবা। পৃথিবীর সকল সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ নায়ক, যার কোন টিভির পর্দায় সিনেমা না থাকলেও তারদ্বারা রচিত বাস্তব জীবনের একটি সিনেমার কাছে পৃথিবীর সকল সিনেমা হেরে যেতে অনায়াসেই রাজি হয়ে যাবে।
আমি সিটটাতে বসলাম, বসার পর থেকেই দেখলাম লোকটার দায়িত্বশীলতা ও চোখের কোনে আটকে থাকা আকাশ পরিমাণ ভালবাসা তার নিজের সন্তান ও স্ত্রীর প্রতি। লোকটা একটু পরপরই স্ত্রী ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে তাদের বিন্দুপরিমান সমস্যা হচ্ছে কিনা, কিছু খাবে কিনা, কিছু লাগবে কিনা, খারাপ লাগছে কিনা, আরো কত রকমের কেয়ারিং, যেটা একজন এতিম ছেলেমেয়ে বা স্বামীছাড়া কোন মহিলা কল্পনাও করতে পারবে না। মেয়েটা তার মায়ের কোলে কাতহয়ে শুয়ে আছে, আর লোকটা বারবার সিটথেকে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের খেয়াল করছে। আমি শুধু নিরবে দৃশ্যগুলো দেখে যাচ্ছি ও আমার নিজের বাবা মায়ের কথা ভাবছি হয়তো এর চেয়েও বেশি যত্নে আমার বাবা মা তাদের সাধ্যের মধ্যে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে।
হাসিমুখে মেনে নিয়েছে আমার সকল অদরকারী আবদারগুলো আর ভালবেসে গেছে কোন প্রকার স্বার্থ ছাড়া। দেখে একটু নিজেকে অসহায় মনে হলেও এটাই বাস্তবতা, ভাবছি আজকে হয়তো আমার সাথে আমার বাবা মা থাকলে তারাও আমাকে এমনভাবে আগলে রাখার চেষ্টা করতো, আমি যত বড়ই হইনা কেনো।
আমি দেখলাম লোকটাকে তার দায়িত্বশীলতার প্রতি কতটা সজাগ ও লোকটার প্রতি তার স্ত্রীর কতটুকু ভরসা। আর মেয়েটার তার বাবা-মায়ের প্রতি কতটা ভালবাসাপূর্ণ হেয়ালিপনা। আস্তে আস্তে এসে গেল তাদের গন্তব্যেস্থল বনপাড়া নেমে গেল তারা। মেয়েটা যাবার সময় শুধু ৩ সেকেন্ডের জন্যে একবার তাকালো আমার দিকে আর তখন আমি নিজেই মাস্ক পরা।
আমি লোকটাকে ক্লান্ত হয়ে যেতে দেখেছি কিন্তু, তার পরিবারের দায়িত্ব ও ভালবাসার প্রতি হেরে যেতে দেখিনি। স্যালুট আপনাকে, আপনার দায়িত্ব ও ভালবাসাকে।
অজান্তেই চোখে পানি এসে পড়ল, যে বাবা মা আমাদেরকে এত্ত কষ্ট করে এত সুন্দর পৃথিবী দান করেন নির্দিষ্ট সময় শেষে আমরা তাদেরকেই ভুলে যায়। আজ এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা এই পৃথিবীতে বাবা মায়ের আদরস্নেহ পায়নি, একবার আমরা তাদের জায়গায় নিজদেরকে ধার করিয়ে দেখি পৃথিবীটা কত কঠিন, এই পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে সুখী যাদের কাছে হয়তো গাড়ি বাড়ি বা অগণিত টাকা নেই কিন্তু বেঁচে আছেন তাদের বাবা মা, যেখানে আপনি কখনোই অবহেলার শিকার হবেন না। এই ২০২১ সালে এসে হয়তো, আপনি আপনার প্রেমিক/ প্রেমিকার কাছে থেকে একটা ফরমালিনযুক্ত সতেজ একটা গোলাপ ফুল পেতে পারেন, কিন্তু ফরমালিনযুক্ত ভালবাসা পাবেন না আপনার বাবা-মায়ের কাছে থেকে।
তাই, অবশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে আমার একটা অনুরোধ, কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনি আপনার বাবা-মা কে ছুরে ফেলে দিবেন না। হয়তো তাদেরকে আপনি আভিজাত্যপূর্ণ জীবন দিতে পারবেন না, কিন্তু আপনার সাধ্যের মধ্যে যেটুকু দিতে পারবেন তারা সে টুকু নিয়েই সুখী, কখনোই আপনাকে তাদের শত অপূর্নতার কথা বলবে না।
লেখক: মেহেদী হাসান মেঘ