আয়াসুফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রুপান্তর করায় যারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি করতে চাচ্ছেন বা বিভিন্ন মতবাদ দিচ্ছেন তাদের আয়াসুফিয়া সম্পর্কে মূল ইতিহাস জানা প্রয়োজন।আর ধর্মনিয়ে সমালোচনাকারীদের অবশ্যই সরণে রাখা প্রয়োজন যে মুসলিম শাসক অটোম্যনরা ইউরোপে শাসন করেছে ছয়শ বছর এই সময়ে তারা অন্যান্য ধর্মালম্বীদের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট সহনশীল।জেনে রাখা উচিত ইসলাম কখনোই কাউকে অন্যায় ভাবে কিছু চাপিয়ে দেয়না,সকল কিছু জয় করে উদারতা দিয়ে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার মাধ্যমে।
বিভিন্ন জাতির রাজা এবং সম্রাটরা অনেক বছরের পুরনো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের চেষ্টা করেছেন। যা অবশেষে ১৪৫৩ সালে যুবক তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ জয় করেন।যুদ্ধের পূর্বে সুলতান কয়েকবার দূত পাঠিয়ে চুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানিয়েছেন বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্ট্যান্টাইন ড্রাগাসেসকে। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
যুদ্ধের মাধ্যমে নগর জয় আর চুক্তির ভিত্তিতে নগর জয়ে অনেক পার্থক্য। চুক্তির মাধ্যমে নগর জয়ে অনেক কিছু রক্ষা করা যায় কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়না।শহরের সকল কিছু নির্ভর করে যুদ্ধে জয়ীদের উপরে।তবে সুলতান ফাতিহ বিজিত খ্রিস্টানদেরকে এমন বহু অধিকার দিয়েছিলেন যার নিশ্চয়তা হয়তো চুক্তির মাধ্যমেও পাওয়া যেতনা।তিনি যে মহানুভবতা দেখিয়েছেন তার উদাহরণ সরুপ অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্খকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন,গির্জায় সমবেত হয়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে নিয়মিত প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন, ধর্মযাজকদের ওপর হতে জিযিয়া কর মওকুফ করেছিলেন।
কনস্ট্যান্টিনোপলের বহু খ্রিস্টান বাসিন্দা যুদ্ধে নিহত হয়েছিল,অনেকে পালিয়ে গিয়েছিল।ফলে নগরের জনসংখ্যা কমে যায়।কনস্ট্যান্টিনোপলের নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখা হয়।উসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে বহু নাগরিকদেরকে ইস্তাম্বুলে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়।স্বাভাবিকভাবেই নতুন তুর্কি রাজধানীতে মুসলিমরাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাই অনেক মসজিদের প্রয়োজন হয়।
চতুর্থ শতকে নির্মিত আয়াসোফিয়া গির্জা ছিল কনস্ট্যান্টিনোপলের সবচেয়ে বড় চার্চ যা নিয়ে খ্রিস্টানদের ভিতরেও বিরোধ ছিল যার ফলশ্রুতিতে এর ধরণ পাল্টেছে কয়েক বার। অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে শুরু করা হলেও পরে এটি রোমান ক্যাথলিক গির্জায় রুপান্তরিত হয় যা ৫৭ বছর ব্যবহৃত হওয়ার পর আবার অর্থোডক্স গির্জায় পরিনত হয়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হওয়ার পর এতো বড় গির্জ মুসলিম অধ্যশিত মুসলমান শাসক উসমানীয়দের রাজধানী ইস্তাম্বুলে কোন প্রয়োজন ছিলনা।তবে এতো বড় স্থাপনা ফেলে রাখার চেয়ে বা ভেঙে ফেলার চেয়ে উত্তম বিকল্প হল মসজিদে রূপান্তর।
তাই সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ যাজকদের আয়াসুফিয়া বিক্রি করার আবেদন জানান এবং যাজকরা রাজী হলে নিজ অর্থায়নে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে আয়াসোফিয়া কিনে নিয়ে স্থাপনাটি মসজিদে রূপান্তর করেন।তিনি বিজয়ী হিসেবে গির্জা ছিনিয়ে নিতে পারতেন, রাষ্ট্রীয় টাকায় কিনতে পারতেন, কিন্তু সেসব না করে চুক্তিনামা করে নিজের টাকায় গির্জাটি ক্রয় করেন। এখনো সেই ঐতিহাসিক চুক্তিনামা তুরস্কে সংরক্ষিত আছে যার ভিত্তিতে আয়াসোফিয়া মসজিদ হিসেবে আদালতে রায়ে জিতেছে।
তবে ইস্তাম্বুলে থাকা খিস্টানদের অবশিষ্ট চার্চে উপাসনা করার অনুমতি দেয়া হয়। বাইজেন্টাইন আমলে প্রতিষ্ঠিত ও তুর্কিদের সহায়তায় পুনর্নিমিত কিছু চার্চ এখনো বিদ্যমান আছে ইস্তাম্বুলে। যেমন ১৩৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত সেইন্ট গ্রেগরি দ্য ইল্যুমিনেটর চার্চ অব গালাটা এবং ১২৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত চার্চ অব সেইন্ট মেরি অব মঙ্গলস।সেই সাথে ইউরোপে খিস্টানদের নির্যাতনের স্বীকার ইহুদিদের অটোম্যন সাম্রাজ্যে বসবাস করার এবং ব্যবসা করার সুযোগও দেওয়া হয়।
আজকে যারা আয়াসুফিয়া নিয়ে আহাজারি করছেন, তারা এর প্রকৃত ইতিহাস জানেন না। ইউরোপের অনেক দেশে মুসলিম জনবসতি ছিল। পর্তুগাল, ইতালির উপকূল, গ্রীস ও স্পেন। ইতিহাস সাক্ষী মসজিদ অক্ষত রাখার শর্ত করা হলেও বিজয়ীরা সেসব শর্ত লঙ্ঘন করে মসজিদকে গির্জায় রুপান্তরিত করেছে। যারা আয়াসুফিয়ার নিয়মতান্ত্রিক মসজিদে রুপান্তরের বিরোধিতা করেন, তাদের কাছে ইউরোপিয়ান মসজিদগুলোর কোন ব্যাখ্যা আছে কি?নাকি সমীকরণটা এমন যেহেতু তারা মুসলিমদের ওপর সীমালঙ্ঘন করেছে, তাই মুসলিমরা উদারতাবশত নিজেদের বৈধ অধিকারও ছেড়ে দিব?
কামাল পাশা আধুনিক তুরস্ককের নামে ১৯৩৫ সালে বেআইনি ভাবে আয়াসোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করে তুর্কিদের যে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল তা থেকে ৮৬ বছর পর তারা সেখানে জুম্মার নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুক্তি পেল।তবে মসজিদটি সকল ধর্মালম্বী দর্শনাথীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে আর সেখানে প্রবেশ করতে জাদুঘরের মতো কোন টাকা লাগবে না।
লিখেছেন-
ইয়াসির আরাফাত
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ।