করোনাকালে জবিয়ান পঞ্চপাণ্ডবের শুদ্ধ পথচলার গল্প

মোঃ মেহেদী হাসান

মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…এই গানটা ভাল লাগে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না। গানের এই কথাগুলির মতই আমরা সবাই চাই আশে পাশের দুঃখী, অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে। তবে ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজও নয়। সহজ নয় কথাটা এই জন্য বলা যে মানুষের সদিচ্ছার অভাব আজকাল। আবার অনেককেই পাওয়া যায় লোক দেখানো সহযোগিতা করতে। ফেসবুক ইউটিউবের এ যুগে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের দান করা ও তাদের পাশে সহযোগিতার জন্য দাঁড়ানোর ঘটনা, এসব মাধ্যমে প্রচার করে খুব সহজেই দানবীর  ও মানবতার কাণ্ডারি উপাদি পাওয়া যায়! এসব থেকে বাদ যাচ্ছে না ছাত্রলীগের সাইন বোর্ড ব্যবহার করা অনেক ভুঁইফোঁড় ছাত্র নেতাও! তবে করোনার এই সংকট কালে এরকম মৌসুমি মানবতার কাণ্ডারিদের দেখা মিলছে না।

জীবনের ঝুকি নিয়ে দান আর সহযোগিতার সেলফি তোলার সাহস এরকম মানবতার কাণ্ডারিদের নেই। ভুঁইফোঁড় নেতারা এখন ব্যাঙের মত শীতনিদ্রায়! তবে এর ব্যাতিক্রম দেখা মিলেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রলীগ তরুনের মাঝে। এরা হলেন কনিক স্বপ্নীল ১২ তম ব্যাচ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, মোঃ ইউনুস ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, মোহন আলী ১৩ তম ব্যাচ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাফসান রাজু ১৪ তম ব্যাচ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ফারহান আহমেদ রাফি ১৪ তম ব্যাচ প্রাণীবিদ্যা বিভাগ। কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ববাসীর মত আমাদের দেশের মানুষজনও  স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। বহু মানুষ চাকুরি হারিয়েছে। বিপদে পড়েছে মেসে থাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা।

এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই টিউশনি করে মেসের ভাড়া সহ নিজের পড়াশুনার খরচ চালাত। একদিকে কোভিড-১৯ আর অন্যদিকে টিউশনি বন্ধ থাকায় এসব ছাত্রছাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।  মেসের বকেয়া নিয়ে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে বিচ্ছিন্ন ভাবে। এই অবস্থায় এসব ছাত্রছাত্রীদের তাদের বই পত্র সহ অন্যান্ন মালামাল বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য বিসয় ছিল। তার উপর চলছিল লগডাউন। বিপদ আর আতঙ্কে দূর পাল্লার যাতায়াতে অতি গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাগজ পত্র হারিয়ে যাবারও সংশয় ছিল। আবাসিক হল না থাকায় এই সমস্যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেন একটু বেশিই। এই অবস্থায় এগিয়ে আসেন এই পাঁচ শিক্ষার্থীর দলটি। আর এই দলটি সুসংগঠিত করেন কনিক স্বপ্নিল ও মোঃ ইউনুস নামের দুই শিক্ষার্থী। তারপর থেকে শুরু এদের মানবতার গল্প। বিপদে থাকা এসব অসহায় শিক্ষার্থীদের মালামাল রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নিউটন হাওলাদার স্যারের সহযোগিতায় ধোলাইপাড় সংলগ্ন দনিয়া বাজার এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করা হয়। এরপর থাকে করোনা ভাইরাসের ঝুকি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন এই দলটি বেড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিপদে পড়া শিক্ষার্থীদের খোজে। তারপর তাদের মালামাল প্যাকিং করে প্যাকেটের গায়ে ডিপার্টমেন্ট, ব্যাচ আর রোল লিখে নিয়ে রাখা হয়  দনিয়া বাজারের সেই ফ্ল্যাটে। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি পাঁচ তরুনের এই দলটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত সাবেক বড় ভাইদের কাছ থেকে চাদা তুলে ছাত্রছাত্রিদের মেসের বকেয়া ভাড়া পরিশদের ব্যাবস্থাও করে তারা। বড় রকমের দুশ্চিন্তা থেকে বেঁচে যায় মেস ভাড়া নিয়ে সংকটে পড়া ছাত্রছাত্রীরা। তারা তাদের বকেয়া মেস ভাড়া মিটিয়ে প্রয়োজনীয় মালামাল সুরক্ষিত জায়গায় রাখার সুযোগ পেয়ে এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

এরকম সমস্যায় পরা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের  ১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহিরা খান মিতা বলেন, তারা আমাদের মেসের নয় হাজার টাকা বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে কনসিডার করার ব্যবস্থা করেছে। তাদের এরকম সাহায্য পেয়ে আমরা খুব খুশি। তারা ছাড়া ঢাকা শহরে আমাদের হেল্প করার মত আর কেউ ছিল না। তাদের ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। শুধু মিতা নয় খোজ নিয়ে এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থীর খোজ পাওয়া গেছে যাদের এরকম সাহায্য করেছে পঞ্চপাণ্ডবের এই দলটি।

এবিষয়ে ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১৫ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি একটি সাবলেট বাসায় থাকতাম সেখানে আমার অনেক টাকা ভাড়া বকেয়া হয়ে যায়। বিষয়টা ইউনুস ভাইয়াকে জানালে পরের দিন ইউনুস ভাইয়া ও কনিক ভাইয়া এসে বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে বিষয়টি সমাধান করে যান।

এবিষয়ে কনিক স্বপ্নিল বলেন, করোনার মধ্যে মেসে থাকা আর টিউশনি করে চলা শিক্ষার্থীরা চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে এসব শিক্ষার্থীদের পাসে দাঁড়ানো আমার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর একজন ছাত্রলীগ কর্মী হয়ে এই সময় সাধারন ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা গুলি সমাধান করা চেষ্টা করা তো আমার সাংগঠনিক কর্তব্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করার ব্যাড প্রাকটিস এর সময়  কনিকের এমন কথায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এমন ব্রতই যে কাম্য প্রতিটা ছাত্রলীগ কর্মীর। কনিক স্বপ্নীল, আলমগীর হৃদয়, রাফসান রাজু, মোহন আলীর  মত ছাত্রলীগ কর্মীই যে আমাদের দেশে দরকার। এখন পর্যন্ত মোট ১১২ জন ছাত্রছাত্রীর

মেস ভাড়া সংকট নিরসন করে তাদের মালামাল রাখার ব্যাবস্থা করেছে এই পাঁচ শিক্ষার্থীর দল। এই পাঁচ তরুনের মত সেবার ব্রত ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটা ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মাঝে এটাই আমাদের সকলের কাম্য। তবেই যে মানুষ মানুষের জন্যে… গানের সার্থকতা। কনিক স্বপ্নীল, রাফসান রাজু, মোহন আলী, ফারহান আহমেদ রাফি ও মোঃ মেহেদী হাসানরা বুঝিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ মানেই স্লোগান আর মহড়া নয় বরং সময়ের প্রয়োজনে সাধারন অসহায় মানুষের পাসে নিঃস্বার্থ ভাবে দাঁড়ানো। ভুলে গেলে চলবে না দেশের সবচেয়ে পুড়নো ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছিল এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, বাঙ্গালির মুক্তির সনদ আদায়ের লক্ষে। ইতিহাসে এর প্রমান মেলে অহরহ। ছাত্র অবস্থায় মানব সেবার এরকম ব্রত লালন করে রাখা ছাত্রলীগ কর্মীই যে এদেশে দরকার। এরাই যে হবে ভবিষ্যতের লোভ লালসা বিহীন আদর্শ নেতা। ছাত্রলীগের সেইসব গৌরবময় ইতিহাসের পথে জবিয়ান এই পঞ্চপাণ্ডবের বিচরনে শুভ ভাবনার উদয় হচ্ছে জনমনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সব কিছুকে জয় করার সময়। জাগ্রত হোক শুদ্ধ মানবতার, উদ্রেক হোক স্বদিচ্ছার– প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর। ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত থাকা আর না থাকা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে প্রবল ভাবে বেজে উঠুক বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী সেই গান “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ……… ও বন্ধু।”

লেখক: সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *