সাইদুল ইসলাম সাঈদ
বুড়িগঙ্গা নদীর পাশ ঘেঁষে তৈরি হওয়া শত জনপদ আর কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই জগা বাবুর পাঠশালা অন্যতম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাঠশালা, স্কুল ও কলেজ থেকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
আজ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৫ পেরিয়ে ১৬ বর্ষে পা দিয়েছে। “জন্মদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়”
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ ১৬২ বছরে পদার্পণ করেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৮ সালে মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ যায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জগন্নাথ পাঠশালা। যা অনেকের কাছে জগা বাবুর পাঠশালা নামেও পরিচিত।
পাঠশালা থেকে ২ বছরের মাথায় জগন্নাথ স্কুল শুরু হয়। শিক্ষানুরাগী ব্রজ সুন্দর মিত্র, অনাথ বন্ধু মৌলিক,পার্বতী চরণ রায় ও দীননাথ সেনের যৌথ প্রচেষ্টায় জগন্নাথ স্কুল থেকে ব্রাহ্ম স্কুলের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ব্রাহ্ম স্কুল পরিচালনার ভার ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী গ্রহণ করেন। তিনি এর নাম বদলে পুনরায় তাঁর পিতার নামে রাখেন জগন্নাথ স্কুল। ১৮৮৪ সালে এটি ২য় শ্রেণীর কলেজ ও পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে এটি প্রথম শ্রেণীর কলেজের মর্যাদা লাভ করে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি বন্ধ হয়ে যায়। জগন্নাথ কলেজ তাঁর শিক্ষক,শিক্ষার্থী ও দুর্লভ সব বই দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
এরপর ১৯২১ সালে নামকরণ করা হয় জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। বঙ্গভঙ্গের পর জগন্নাথ কলেজই ছিল বাংলার রাজনীতির আঁতুড়ঘর।
বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এখানেই ঢাকাবাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দ ঢাকায় এসে প্রথমেই জগন্নাথ কলেজে বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৪৯ সালে পুনরায় এখানে স্নাতক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে এর নামকরণ করা হয় সরকারি জগন্নাথ কলেজ এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর এর নামকরণ করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
শুধু পূর্ববঙ্গ নয় সমগ্র ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছিল স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ ছিল এই প্রতিষ্ঠানেরই হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তার স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রফিক ভবন নামে একটি ঐতিহাসিক ভবন দাড়িয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও জগন্নাথের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে জগন্নাথের উদ্যোগেই প্রথম প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এ সম্পর্কে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, “সকল আন্দোলন সংগ্রামে আমরা চাতক পাখির মত চেয়ে থাকতাম কখন পুরান ঢাকা থেকে জগন্নাথ মিছিল বের করে।” ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ও ২৬শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর জগন্নাথ কলেজে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৫ শে মার্চের গণহত্যার স্বাক্ষী হিসেবে দেশের একমাত্র ভাস্কর্য এখানে বিদ্যমান।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান অপরিসীম। খেলাধুলা থেকে শুরু করে যে কোন প্রতিযোগিতাতেও পিছিয়ে নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। রোনাল্ডসে শিল্ড,স্যার এ এফ রহমান শিল্ড,ফিরোজা নূন কাপ জয়ের মত গৌরব আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
আমাদেরই শিক্ষার্থী ব্রজেন দাস ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এস এ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন এই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী আমাদের ছোটবোন মারজান আক্তার প্রিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো আবাসিক হল না থাকা সত্ত্বেও নিজের টিউশনের টাকায়
চালিয়ে নেয় নিজেকে, অনেক সময় অনেক শিক্ষার্থীকে নানা ভোগান্তির মধ্যে পরতে হয়, তবুও জবিয়ানরা চালিয়ে যায় জীবন সংগ্রাম। রাজনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা রেখে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে কাজ করে যায় ও দেশসেবক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রোবার স্কাউট, বিএনসিসি বাঁধন, সাংবাদিক সমিতি, প্রেসক্লাব সহ অনেক সংগঠনে সমৃদ্ধ এ ক্যাম্পাস। এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য ক্লাব।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, কবি ও কথা সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী মোতাহের হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত ও নূরুল মোমেন, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আনিসুজ্জামান,শহীদ বুদ্ধিজীবী ড: শামসুজ্জোহা, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম,বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন,অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, নায়ক ফারুক, ব্যান্ড শিল্পী বিপ্লব সহ অনেক গুণী মানুষের পদচারণায় গর্বিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থেকে দেশ সেবায় ব্যাপৃত আছে এই প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষার্থী।
শুভ জন্মদিন, আমার পরিচয়ের লালিত স্বপ্নে পাখা উড়ানোর প্রিয় প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আপন মহিমায় এগিয়ে যাও প্রাণের বিদ্যাপীঠ।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।